Anup Bandyopadhyay Website Logo
ads1-728x90

মানভূম ভাষা আন্দোলন

মানভূম ভাষা আন্দোলন
=====================

মানভূম ভাষা আন্দোলন

” মানভূম “– নামে কোনো জেলার অস্তিত্ব এখন আর ভারতের মানচিত্রে পাওয়া যাবে না। কিন্তু কেন? মানভূম ভাষা আন্দোলন-ই বা কেন সংগঠিত হয়েছিল? ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলার সময় এসেছে। আমরা ২১ফেব্রুয়ারি জানি ।আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা এই ভাষা দিবসকে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। ১৯ মে কাছাড় ভাষা শহিদ দিবসও পালিত হয়। কিন্তু, ১নভেম্বর মানভূম ভাষা দিবস হিসেবে পালিত সেই অর্থে হয়না।

১৯১২– র ১ এপ্রিল ধরলে এই ২০২২ -এ ‘ মানভূম ভাষা আন্দোলন ‘ -র ১১০ বছর। কিছু কিছু গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু জনমানসে তার ছবি খুবই অস্পষ্ট। মানভূম জেলার অস্তিত্বের কথাও আমরা ভুলে গিয়েছি।

নানান ঐতিহাসিক মতামতকে আপাতত সরিয়ে রেখে বলা যায় যে ১৮৩৩-র Regulations of 1833 -র Section V- র ত্রয়োদশ রেগুলেশন অনুযায়ী জঙ্গল মহল জেলাকে ভেঙ্গে “মানভূম “-জেলা তৈরি করা হয়। অধিবাসীদের মধ্যে বাঙালিরাই ছিলেন সংখ্যা গরিষ্ঠ। এই বিভাজনের আগে থেকেই রাজস্ব আদায়ের নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলে যে অত্যাচার তার বিরুদ্ধে এখানে বিদ্রোহ সংগঠিত হয় ( চুয়ার বিদ্রোহ ১৭৬৭ – – ১৭৯৯ )। স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চল ইংরেজ সরকারের কুনজরে পড়ে। এরই ফলস্বরূপ মানভূম জেলাকে ক্রমশ ছোট করে ফেলা হয় — ১৮৪৫- এ ধলভূম পরগণাকে বিচ্ছিন্ন করা হয়, ১৮৪৬ – এ ছাতনা-কে বিচ্ছিন্ন করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই– বাঙালি জাতির মুলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে মানভূমকে দুর্বল করা। আমরা জানি যে- ১৯০৫ – র ১৯ জুলাই লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ঘোষণা করেন এবং সারা বাংলা জুড়ে তীব্র প্রতিবাদ ও আন্দোলনের ফলে ১৯১১ -র ১২ ডিসেম্বর রদের ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এরসাথে সাথেই কলকাতা থেকে দিল্লিতে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ১৯১২ র ১ এপ্রিল মানভূম ও ধলভূম কে বিহার- ওড়িষ্যার সাথে জুড়ে দেওয়া হয়।

বিহারের জনগণ নিজেদের জন্য একটা পৃথক রাজ্য দাবি করতে থাকলেন। আন্দোলন আরম্ভ হোলো– ধ্বনি উঠল – Bihar for Biharis’।মানভূমের বাঙালি অধিবাসীরাও বিহারের সাথে নিজেদের সংযুক্তি মেনে নিতে পারেন নি। এখানেও আন্দোলন আরম্ভ হোলো। মানভূমকে বাংলার সাথে যুক্ত করাবার দাবিতে চারদিকে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়লো। ১৯৩০ এর আইন অমান্য কে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন একটা চরম রূপ নিচ্ছিল টুসু গান এই আন্দোলনের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। ১৯৩৬ এ বিহার ও ওড়িষ্যা দুটি আলাদা রাজ্য হোলো।

Also Read: 75 Years Of Independence And Our Languages

এর ফল মারাত্মক হোলো। বিহার চাইল মালভূম, ধলভূমকে হিন্দিভাষী অঞ্চলে পরিনত করতে। আদেশ দেওয়া হোলো– Dr. Rajendra Prasad stressed the necessity of propagating Hindi in Singhbhum and Dhalbhum so that they might be claimed as Hindi speaking areas and thus dangers of territorial integrity of the province of Bihar could be averted.

বাংলার পক্ষে যাঁরা আন্দোলন করছিলেন, তাঁদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন আরম্ভ হোলো। হিন্দির পক্ষে আসার জন্য নানান ধরনের প্রলোভন দেখানো শুরু হোলো।অন্যদিকে ভয় দেখানো শুরু হোলো। হিন্দি মাধ্যমে শিক্ষাদান না করা হোলে, প্রতিটি বিদ্যালয়ের নাম ইংরেজির বদলে হিন্দিতে না লিখলে, প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে

‘ রামধুন’ চালু না করলে, বিদ্যালয়ের অনুদান তো বন্ধ হবেই, সরকারি স্বীকৃতিও চলে যেতে পারে। এরসাথে আবার অর্থনৈতিক চাপও তৈরি করা হয়। ধান,চাল বিক্রি করা নিষিদ্ধ করা হয়, জোয়াল,ঢেকি-র উপর কর চাপানো হয়। ‘ মুক্তি ‘, শিল্পাশ্রম, তরুণ শক্তি, সার্চলাইট পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পত্রিকা সম্পাদকদের আটক করা হয়। পুরো বিষয়টিকেএমন ভাবে প্রচার করা হয় যাতে মনে হয়– বাংলার পক্ষে কথা বললেই — প্রাদেশিক, বিভেদকামী আর হিন্দির পক্ষে কথা বললেই জাতীয়তাবাদী। বিভিন্ন কমিটি গঠন করা হয় এবং তার কর্মসূচিও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। যেমন- হিন্দি কে অবশ্য পাঠ্য করতে হবে, শিক্ষাদানে বিহারিদের প্রাধান্য দিতে হবে, নিরক্ষরতা দূরীকরণে কেবল হিন্দিকেই শেখাতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা, বিভিন্ন রকমের অনুদান, কৃষি ঋণ,জমি উন্নয়ন ঋণ,জলসেচ ঋণ — সবই পাওয়া যাবে কেবল মাত্র হিন্দি ব্যবহার করলেই, নচেৎ নয়।

Read More: রবীন্দ্রনাথ ও মাতৃভাষা

এইভাবেই একদিন রাজ্য সীমানা পুনর্গঠন কমিশনের রিপোর্ট চলে আসে। প্রচুর বাকবিতণ্ডা হয়। অবশেষ ১৬ জানুয়ারি ১৯৫৬ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। বাংলা ও বিহার সম্পর্কে বলা হয়—- বিহার থেকে পুরুলিয়া সদর মহকুমার ১৬টি থানা ও কিষাণগঞ্জের মহানন্দা নদীর পূর্বাঞ্চল – এই মোট ৩২০০ বর্গমাইল এলাকা বাংলারসাথে যুক্ত হবে। ধানবাদ মহকুমা, পুরুলিয়া সদর মহকুমার চাস ও চন্দনকিয়ারী, চান্ডিল, ইটাগড় ও পটমদা থানা বিহারে থাকবে। এইভাবে বাংলাভাষীদের টুকরো টুকরো করে দেওয়া হয়। ওদিকে বিহারও চেষ্টা করছিল পুরো অঞ্চলটাকেই হিন্দিভাষীতে রূপান্তরিত করে একটুও পশ্চিমবঙ্গকে না দিতে। ফলে উভয় পক্ষেরই অসন্তোষ বিক্ষোভে রূপান্তরিত হোলো – হরতাল, অরন্ধন ইত্যাদি শুরু হোলো। এই অসন্তোষ দমন করার জন্য ২৩ জানুয়ারি ১৯৫৬ – তে দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ড.বিধান চন্দ্র রায় ও ড.শ্রীকৃষ্ণ সিংহ এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলা-বিহার সংযুক্তির কথা ঘোষণা করলেন। স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলন, বিক্ষোভ তীব্রতর হোলো । লোকসেবক সংঘের নেতা অতুল চন্দ্র ঘোষ কর্মিসভায় ঘোষণা করলেন– ১০০০ সত্যাগ্রহী ২০ এপ্রিল পুরুলিয়া থেকে রওনা দিয়ে পায়ে হেঁটে ৭ মে কলকাতা পৌঁছোবে। চারদিকে খুবই আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এই সংযুক্তিকরণকে প্রধান বিষয় করে যে উপনির্বাচন হয় ড.বিধান চন্দ্র রায় তাতে হেরে যান। ফলে এই অভিযান চলাকালীনই ৩ মে সন্ধ্যায় তিনি ‘ বঙ্গ- বিহার সংযুক্তিকরণ’ – র প্রস্তাব প্রত্যাহার করেন।

১৯৫৬ র ১ নভেম্বর খন্ডিত মালভূম, পুরুলিয়া জেলা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত হোলো। ‘মানভূম ‘ জেলা বলে আর কিছু থাকলো না।

ভাষার জন্য, সংস্কৃতির জন্য লাগাতার ৪৪ বছরের আন্দোলনের ইতিহাস পৃথিবীতে নেই।

আর আমরা এই আন্দোলনের ঐতিহ্যকেই ভুলতে বসেছি।

নমস্কার।

ads1-728x90

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.