Anup Bandyopadhyay Website Logo
ads1-728x90

স্বাধীনতার সাতে- পাঁচে মাতৃভাষার হাল- হকিকত

স্বাধীনতার সাতে- পাঁচে মাতৃভাষার হাল- হকিকত

==================================

প্রথম দৃশ্য:

১০ মার্চ, ১৯৪৭ । দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। ডা. সুরেশ চন্দ্র ব্যানার্জি বিধানসভায় বাংলায় কথা বলতে আরম্ভ করলেন। অমনি বাধা। বাংলায় বলা যাবে না। কেউ কেউ আবার ১৮৩৫ – এর ৮৫ নং ধারার কথা তুললেন। সুরেশবাবু দমে তো গেলেনই না উল্টে বললেন–
” আমার মতে যে সমস্ত ইংরেজ এখানে বসে আছেন তাঁরাও বাংলায় বলতে আরম্ভ করুন। ”

দ্বিতীয় দৃশ্য:

১৯৫২। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে মাতৃভাষা বাংলার জন্য বাঙালি প্রান উৎসর্গ করেছে। এই ঘটনার মাত্র পাঁচ মাস পরে- ২৫ জুলাই আমাদের এই বাংলার বিধানসভায় কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা বিল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রিয়রঞ্জন সেন মহাশয় বলছেন: ” আমরা যদি আজকের দিনে বাংলা ভাষার অজুহাতে বা অন্য কোনো অজুহাতে হিন্দি শিখতে অবহেলা করি, যেমন একজন সদস্য ঐ ধরনের একটা মোশন দিয়েছেন, তাহলে ইংরেজ আমলে, প্রথমে ইংরেজি শিখতে মুসলমানরা অগ্রসর না হওয়ায় তাদের সমাজের যে অবনতি ঘটেছিল, আমরাও সেই দুর্দশায় পতিত হব।”
অবশ্য ৪ জুলাই শ্রীযুক্ত কালী মুখার্জি বলছেন:

” মাননীয় অধ্যক্ষ মহাশয়, গত দু-দিন ধরে এখানে যে সমস্ত বক্তৃতা হয়েছে তার অধিকাংশই বাংলায় এবং কিছু ইংরেজিতে — সুতরাং আমি আপনাকে অনুরোধ করব আমাকে রাষ্ট্রভাষায় বলতে দিন “।

স্বাভাবিকভাবেই এরপর তিনি হিন্দিতেই বক্তব্য রাখেন।

Also Read: প্রতিবাদের শঙ্খ ধ্বনি

তৃতীয় দৃশ্য:

১৯৬১ তে আমাদের ভাষা আইন হয়ে গিয়েছে। অথচ ১৯৬৫তে রাজ্যপালের ভাষনের বাংলা ভাষান্তর টেবিলে দেওয়ায়, ৮ ফেব্রুয়ারি, সিদ্ধার্থ শংকর রায় বলছেন: ” আমি আমার টেবিলে দেখছি কেবলমাত্র বাংলায় দেওয়া হয়েছে– এর ইংরেজি কপি পাব কি ?”

এই তিনটি দৃশ্য কয়েকটি নমুনা মাত্র। আমাদের আইনসভাতেই যদি এই চরিত্রের মানসিক নির্লিপ্ততা, উৎসাহহীনতা বা মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাহীনতা দেখা যায় তাহলে জাতীয় ঐক্যের জিগীর তুলে কয়েকটি অঞ্চলের ভাষাকে ইংরেজির জায়গায় বসিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র তো চলবেই। উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং হরিয়ানা– এই সাতটি রাজ্যের জনসংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি (৫৫%)। ভোটের রাজনীতিতে এই জনসমষ্টির মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অমিত সাহ তাই হিন্দির সম্প্রসারেণর (সন্ত্রাস?) কাজে লেগে পরেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো কোন্ হিন্দি? রাষ্ট্রীয়হিন্দি? মাতৃভাষা হিন্দি? বাজারি হিন্দি? নাকি রাষ্ট্রীয় কাজের জন্য বিশুদ্ধ হিন্দি– যেখানে

Read More: শঙ্খ ঘোষের প্রতিবাদের ভাষা

‘ভাত’ – পুংলিঙ্গ, কিন্তু ‘ডাল’ — স্ত্রীলিঙ্গ? ‘ জন্ম ‘ – পুংলিঙ্গ তো ‘ মৃত্যু ‘ — স্ত্রীলিঙ্গ ? রাষ্ট্রীয় হিন্দি তৈরি করার সময় তো ভোজপুরি, রাজস্থানি,চুরাহি, লারিয়া, মারওয়ারি, সুগালি- র মত ৫৫টি মাতৃভাষার জনসমষ্টিকে (১৬৪,১২৯,০০৭ জন) হিন্দি মাতৃভাষার (২৫৭,৯১৯,৬৩৫ জন) জনসংখ্যার সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাহলে এই ৫৫টি ভাষার নাগরিকেরা , যাঁরা হিন্দিকে মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করেননি এবং ভারতের অন্যান্য ভাষাগোষ্টির নাগরিকদের কোন্ গণতান্ত্রিক অধিকারে হিন্দি ভাষায় ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে? ভারতের মাত্র ২৬.৬১ % নাগরিকদের উন্নতিই যদি একমাত্র লক্ষ্য হয়ে থাকে তাহলে আজ সময় এসেছে প্রশ্ন করার– কেবল হিন্দির উন্নতি কাম্য নাকি ভারতের ঐক্য কাম্য? তাহলে পৃথিবীর সমস্ত জ্ঞান- বিঞ্জানের বই, গবেষণা গ্রন্থ, পত্রিকা ইত্যাদিকে হিন্দিতে অনুবাদ করলেই অমিত সাহজির কাজ শেষ হয়ে যাবে না । কেননা হিন্দি মাধ্যমে যাঁরা পড়াশোনা করবেন তারা যাতে পৃথিবীর অবশিষ্ট মানুষের সাথে সবরকম যোগাযোগ করতে পারেন তার জন্য সারা পৃথিবীর সব মানুষকেই হিন্দিভাষী করে তোলারও দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিঃসেন্দহে মহান কাজ– কিন্তু পারবেন তো ? অতএব এই ২৬.৬১%- – র মধ্যে যত শতাংশ আবার শিক্ষিত অথবা উচ্চশিক্ষিত আছেন অথবা ভবিষ্যতে হতে চাইবেন, তাঁদের আহ্লাদিত হবারও কোনো কারণ দেখছি না।

ওদিকে, ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রাষ্ট্রীয় হিন্দি যেসব ভাষা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে তাদের বৃদ্ধির হার থেকে অনেক ক্ষেত্রেই অনেকটা কম- যেমন ২০০১-২০১১ তে ভারতের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার যেখানে মাত্র ১৭.৬৪% সেখানে ব্রজভাষার বৃদ্ধির হার ১৭২.০২%, সোন্ডওয়ারির বৃদ্ধির হার ২৪৪.০২%। এবার যদি আরেকটু গভীরে যাই তাহলে দেখতে পাচ্ছি ভারতে ভিলি/ভিলিডি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ২০০১ – র তুলনায় ২০১১- তে ৮,৩০,৬৮০ জন বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু গুজরাতে কমেছে ১৫,৭৯,৭২১ জন। আবার ভারতে লাদাখি মাতৃভাষা ছিল ১,০৪,৬১৮ জনের।কিন্তু ২০১১ – তে কমে হয়ে গেল মাত্র ১৪,৯৫২ জন। কোথায় যাচ্ছেন আমাদের এই সহনাগরিকরা? ১৬ মার্চ ১৯৭৩, বিধানসভার প্রশ্নোত্তর পর্ব থেকে জানতে পারছি— ১৯৬১ সালের জনগণনা অনুসারে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীরা যে সব ভাষায় কথা বলেন তার মোট সংখ্যা ছিল ২৭৭টি এবং দশ হাজারের বা তার থেকে বেশি ব্যক্তি যে সব ভাষায় কথা বলেন তেমন ভাষার সংখ্যা ২৬টি। এর মধ্যে ১ জন বক্তা ছিলেন ৮টি ভাষাতে, ২ জন বক্তা ছিলেন ১৯টি ভাষাতে, ৩ জন ৭টি ভাষাতে, ৪ জন ৭টি ভাষাতে এবং ৫ জন ছিলেন ১২ টি ভাষাতে। গ্রীয়ার্সনের ‘ লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া ‘ অনুযায়ী এই ২৬টি ভাষার মধ্যে ১৮টি ভাষার বর্ণমালাও রয়েছে। আমরা কিন্তু এঁদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানিনা। কোনো কোনো ভাষার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির হার আবার কোনো ভাষার অস্বাভাবিক হ্রাসের হার বা একেবারে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে – তাহলে কি এই ভাষাভাষী মানুষেরা কোনো রকম চাপের কাছে নতি স্বীকার করে অন্য কোনো ভাষাকে তাঁদের মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছেন ?
স্বাভাবিক ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়েই একটি ভাষার উন্নতি হয় – বাইরে থেকে জোরজবরদস্তি করে নয় — তার পরিনাম হয় চরম শত্রুতা। সাত সুরের বৈচিত্র আমাদের অহংকার, সাত রঙের বৈচিত্র আমাদের অহংকার, ভাষার বৈচিত্রও আমাদের বৈশিষ্ট্য, আমাদের অহংকার। একমাত্র সাম্রাজ্যবাদীরাই চান– এক ভূখণ্ড, এক জাতি, এক ধর্ম, এক ভাষা, এক নেতা । ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা – আমাদের বাংলা ভাষা। আমরা কিছুতেই আমাদের দায়িত্ব এড়াতে পারি না।এই ভাষা সন্ত্রাস আমাদের রুখতেই হবে।এ বছর ১৯১২ র মানভূম ভাষা আন্দোলনের ১১০ বছর।দীর্ঘ ৪৪ বছর আন্দোলন করে ১৯৫৬ র ১ নভেম্বর বাঙালি অংশত হলেও জয়লাভ করেছিল।

আর তা না হলে হয়ত স্বাধীনতার পরবর্তী সাতে পাঁচে অর্থাৎ ১৫০ বছরে বিধানসভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে কোনো সদস্য প্রশ্ন করবেন– তথ্য- সংস্কৃতি ও জনসংযোগ বিভাগের মন্ত্রী মহাশয় অনুগ্রহপূর্বক জানাইবেন কি —

ক) পশ্চিমবঙ্গে এই মূহুর্তে দেবনাগরী হরফে কতগুলি বাংলা ভাষার দৈনিক ও পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হয়?

খ) তাহাদের দৈনিক প্রচার সংখ্যা কত ?

ads1-728x90

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published.